স্বাস্থ্য কি? অর্থাৎ স্বাস্থ্য বলতে আমরা কী বুঝি তা প্রথমে জানা প্রয়োজন। সাধারণত, আমরা স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক সুস্থতা বা শরীরের নিরোগ অবস্থাকে বুঝি। কিন্তু স্বাস্থ্য শুধুমাত্র শারীরিক সুস্থতা নয়; এর সাথে মানসিক সুস্থতাও অপরিহার্য। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি দৈহিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকলেই তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলা হয়।
মানুষের বেঁচে থাকা, স্বাস্থ্য রক্ষা এবং শরীরের বৃদ্ধির জন্য খাদ্য অপরিহার্য। তবে সেই খাদ্যকে হতে হবে পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ও সুষম। পুষ্টিকর খাদ্য বলতে আমরা সেই সব খাবার বুঝি, যা শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখে। সুষম খাদ্য হলো এমন এক ধরনের খাদ্য, যেখানে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান সঠিক অনুপাতে ও পরিমাণে থাকে। সুষম খাদ্যই শরীরের পুষ্টি সরবরাহ করে।
পোস্ট সূচিপত্র: সুস্থ জীবনের স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজনীয়তা
- ভূমিকা
- পুষ্টির ধারণা ও প্রয়োজনীয়তা
- সুস্থ দেহের জন্য শক্তি ও ক্যালরির পরিমাণ
- খাদ্য বিষক্রিয়া, কারণ, লক্ষণ ও প্রতিবিধান
- উপসংহার
ভূমিকা
সুরক্ষা এবং শরীরের সঠিক বৃদ্ধির জন্য যথাযথ সময়ে সুষম খাদ্য পরিমাণমতো গ্রহণ করা জরুরি। তবে বিভিন্ন বয়সের জন্য সুষম খাদ্যের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে। যেমন, একটি শিশুর জন্য যে পরিমাণ আমিষ, শর্করা এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান দরকার, একজন কিশোর বা কিশোরীর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি প্রয়োজন। বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী সুষম খাদ্যের চাহিদার তারতম্য ঘটে। শৈশবে বেশি আমিষের প্রয়োজন হয়, এবং যারা শারীরিক পরিশ্রম করে তাদের জন্য তাপ উৎপাদনকারী খাদ্য বেশি দরকার। সন্তানসম্ভবা এবং প্রসূতি মায়ের জন্য পুষ্টির চাহিদা সাধারণ নারীর চেয়ে বেশি। তাছাড়া, রোগ ভোগের পর পুষ্টির চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি থাকে।
পুষ্টির ধারণা ও প্রয়োজনীয়তা
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক বৃদ্ধি অত্যন্ত দ্রুত হয়, যা সমর্থন করার জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি অপরিহার্য। শরীরের শক্তি সরবরাহ, ক্ষয়পূরণ, এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য এই সময়ে সুষম খাদ্য যথাযথ পরিমাণে গ্রহণ করা প্রয়োজন। যদি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ না করা হয়, তবে শরীর ও মনের বৃদ্ধি এবং বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, আর প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। এজন্য অন্যান্য সময়ের তুলনায় বয়ঃসন্ধিকালে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন অনেক বেশি। এই বয়সে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা, দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা ইত্যাদিতে সক্রিয় থাকে, যা তাদের জন্য বেশি ক্যালরি ও খাদ্য শক্তির চাহিদা তৈরি করে। যদি পুষ্টিমান কম থাকে এবং সঠিক খাদ্য গ্রহণ না করা হয়, তাহলে দেহের বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়।
**খাদ্য উপাদান:** খাদ্যে মোট ছয়টি প্রধান উপাদান থাকে। এগুলো হলো প্রোটিন বা আমিষ, কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা, ফ্যাট বা স্নেহ, ভিটামিন, মিনারেল বা খনিজ পদার্থ এবং পানি। যেকোনো খাদ্যে যে উপাদানটি প্রধান, সেই খাদ্য সেই উপাদানের নামে পরিচিত হয়।
**খাদ্য উপাদানের উৎস ও গুণাগুণ:** আমিষ বা প্রোটিন জাতীয় উপাদান দেহ গঠন, বৃদ্ধি, এবং ক্ষয় পূরণে সাহায্য করে। এটি দেহের কর্মশক্তি যোগায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মাছ, ডিম, দুধ, মাংস, পনির, সয়াবিন, ডাল এবং তিন জাতীয় সবজির বীজে প্রচুর পরিমাণে আমিষ পাওয়া যায়। শর্করা ও স শ্বেতসার মূলত দেহের তাপ এবং কর্মশক্তি যোগায়। চাল, গম, ভুট্টা, আলু, চিনি, মধু, ওল এবং মিষ্টিতে শর্করা ও শ্বেতসার পাওয়া যায়। দেহের অভ্যন্তরীণ গঠনের জন্য খনিজ পদার্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেহে লোহা, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়োডিন, সোডিয়াম, এবং পটাশিয়ামের মতো খনিজ পদার্থ থাকে, যা প্রতিদিন মল, মূত্র, এবং ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এই ক্ষয় পূরণের জন্য খনিজ লবণ সমৃদ্ধ খাদ্য, যেমন লবণ, দুধ ও দুধজাত দ্রব্য, ছোট মাছ, মাংস, ডিমের কুসুম, নানা রকম ডাল, শাকসবজি, লেবু, কলা, এবং ডাবের পানি খেতে হয়। দেহের প্রায় ৭০ শতাংশই পানি দ্বারা গঠিত। পানি দেহের গঠন বজায় রাখে, দেহকে ঠান্ডা ও সচল রাখে, খাদ্য হজমে সাহায্য করে, রক্ত চলাচলে সহায়তা করে এবং দেহের বর্জ্য নিঃসরণে ভূমিকা রাখে।
সুস্থ দেহের জন্য শক্তি ও ক্যালরির পরিমাণ
আমিষ, শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাদ্য পরিপাকের পর দেহে তাপ উৎপন্ন হয়। খাদ্য থেকে উৎপন্ন তাপ মেপে খাদ্যের ক্যালরির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। খাদ্যের ক্যালরি মূল্য কিলোক্যালরি হিসেবে প্রকাশ করা হয়। যেমন, ২৫০ গ্রাম দুধ থেকে ১৬৫ কিলোক্যালরি এবং এক চা চামচ চিনি থেকে ১৬ কিলোক্যালরি তাপ উৎপন্ন হয়। খাদ্যে নিহিত তাপ দেহের কার্যক্রম সচল রাখে এবং শরীরে কাজ করার শক্তি যোগায়। খেলাধুলা, দৌড়ানো, রিকশা বা ঠেলাগাড়ি চালানো, এবং নির্মাণ শ্রমিকের কাজের মতো ক্রিয়াকলাপগুলোতে বেশি শক্তি ব্যয় হয়। শরীরের ওজন বেশি হলে কাজে আরও বেশি শক্তি ব্যয় হয়। দেহের প্রয়োজনীয় শক্তিকে ক্যালরির আকারে এবং কিলোক্যালরি হিসেবে উল্লেখ করা যায়। হালকা, মাঝারি, এবং ভারী কাজ করার জন্য কতটুকু কিলোক্যালরি শক্তির প্রয়োজন হয়, তা অনেকেরই অজানা।
খাদ্য বিষক্রিয়া, কারণ, লক্ষণ ও প্রতিবিধান
আমরা যা খাই, তাকে সবকিছুই খাদ্য বলা যায় না। বরং যা খেলে আমাদের শরীরের ক্ষয় পূরণ, বৃদ্ধি সাধন এবং তাপ সংরক্ষণের কাজ সম্পন্ন হয়, সেটাকেই খাদ্য বলা হয়। প্রতিদিন শারীরিক কার্যকলাপের কারণে আমাদের শরীর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, এবং খাদ্য আমাদের শরীরের এই ক্ষয় পূরণ করে ও কর্মক্ষম রাখে। তবে এসব খাদ্য হতে হবে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এবং সুষম। অতিরিক্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য কখনও কখনও শরীরের উপকারের বদলে ক্ষতির কারণ হতে পারে। যদি খাদ্য দূষিত হয়, তাহলে যে কেউ তা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। দূষিত খাদ্য বিষাক্ত হয় এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করে। যে খাদ্য বা পানীয় খাদ্যনালী ও পাকস্থলীতে ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু দ্বারা দূষিত হয়, সেই খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করলে ফুড পয়জনিং বা খাদ্য বিষক্রিয়া হতে পারে।
**কারণ:** সাধারণত ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত বা টক্সিন বা বিশেষ ধরনের জৈব বিষ দ্বারা খাদ্য বিষক্রিয়া ঘটে। ব্যাকটেরিয়া বিভিন্নভাবে খাদ্যে প্রবেশ করতে পারে, যেমন—খাবার দীর্ঘ সময় ধরে রেখে দিলে, খাবার তৈরির আগে, গ্রহণ করলে খাদ্য বিষক্রিয়া বা ফুড পয়জনিং হতে পারে।
**বিষক্রিয়ার লক্ষণ:** দূষিত খাবার গ্রহণের ফলে পাকস্থলী ও অন্ত্রে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যা বমি বমি ভাব, বমি করা, তলপেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানা, শরীরের পানিশূন্যতা এবং শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। টক্সিনজাতীয় বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন বমি, কোষ্ঠকাঠিন্য, দৃষ্টিশক্তির বিকৃতি, স্নায়ুর পক্ষাঘাত, দুর্বলতা ইত্যাদি উপসর্গ প্রকাশ পায়। এই ধরনের ফুড পয়জনিংকে বটুলিজম বলা হয়। এ ধরনের লক্ষণ সাধারণত খাদ্য গ্রহণের ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা পরে দেখা দেয়। সময়মতো চিকিৎসা না করালে রোগী কয়েকদিনের মধ্যে মারা যেতে পারে।
**প্রতিবিধান:** সুস্থ শরীর এবং জীবনযাপনের জন্য বিভিন্ন নিয়ম-কানুন মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেসব বিষয় শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতির কারণ হতে পারে, সেগুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত।
- খাদ্য প্রস্তুত করার আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
- খাদ্যকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে প্রস্তুতি ও সংরক্ষণের সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- নিরাপদ ও দূষণমুক্ত পানি পান করা আবশ্যক।
- কাঁচা শাকসবজি, মাছ, মাংস ইত্যাদি রান্না করা খাবারের সংস্পর্শে না আসে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
- রান্নার জন্য সবসময় নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে হবে।
উপসংহার
উপরোক্ত বিষয় হতে আমরা জানলাম সুস্থ জীবন যাপনের ক্ষেত্রে পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা। সুস্থ দেহ এবং সুস্থ মন সুস্থ মস্তিষ্কে বাহক। দেহ সুস্থ থাকলে মন সুস্থ থাকে এবং শুধুমাত্র দেহ সুস্থ থাকলেই একজনকে সুস্থ বা সুস্বাস্থ্য বলা যায় না দেহের সঙ্গে সঙ্গে তার মানসিক সুস্থতার প্রয়োজন রয়েছে। সকল সুস্থ তাকে একত্রিত করায় সুস্বাস্থ্য বলা হয়। সুস্বাস্থ্য থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী এবং পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। উপরোক্ত বিষয় হতে আমরা পুষ্টিকর খাদ্য এবং এর গুনাবলী এবং সুষম খাদ্য কাকে বলে এছাড়াও কোন সকল খাদ্যকে সুষম খাদ্য তালিকা রাখা হয়েছে এই বিষয়ে জেনেছি। সুস্থ দেহ ও শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সুষম খাদ্য এবং পুষ্টিকর খাদ্য প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
Comments
Post a Comment